Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

জেলা ক্রীড়া সংস্থা

কোম্পানি শাসনামলের পূর্বে রাজশাহী বা রামপুর বোয়ালিয়া নামক-মৌজাটি পূর্ণাঙ্গ শহরের রূপ পায়নি। সে আমলে (আঠারো শতক) এই জনপদের মানুষেরা কোন ধরনের খেলাধুলা পছন্দ করতেন-কিংবা এরা আদৌ কোন খেলাধুলা নিয়মিত করতেন কিনা অথবা ক্রীড়া বিষয়ে তাদের কোন ধরনের চিন্তাভাবনা কাজ করত কিনা- এ সকল বিষয় আমাদের অজানা। তবে রাজশাহী ছিল নদ-নদী বেষ্টিত অঞ্চল। গ্রামের মানুষেরা নৌকা বাইচ, ষাঁড়ের লড়াই, কুস্তি এসকল খেলায় অংশগ্রহণ এবং উপভোগ করতেন। এই তথ্যগুলো আমরা ইতিহাসে পাই। বাংলার গ্রামীণ জনপদের মানুষেরা আরও যেসব খেলায় অভ্যস্ত ছিলেন সেগুলোর মধ্যে ঘুড়ি ওড়ানো, হা-ডু-ডু, দাড়িয়াবান্দা (অঞ্চল বিশেষে) এবং ডাংগুলি বা চেঙ্গুরপান্টি (বগুড়া অঞ্চলে এই নামে প্রচলিত) ছিল প্রধান খেলা। শহরের ছেলেরা ঘুড়ি ওড়ানো, লাটিমখেলা (লাট্টু), সাঁতার এসব খেলাধূলার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পেতো। শহরের বনেদী মানুষদের মধ্যে তাস, পাশা, দাবা, শিকার করা (ংঢ়ড়ৎঃং) ইত্যাদি খেলার প্রচলন ছিল। অনেকে শখ করে কবুতর পুষতেন। তবে পুরাতন ঢাকার কিছু কিছু নাগরিকের মতো কবুতর উড়ানোর খেলা রামপুর বোয়ালিয়াবাসীদের মধ্যে প্রচলন ছিল বলে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। রাজশাহী শহরে বাহন হিসেবে ঘোড়াগাড়ির প্রচলন ছিল বহুকাল পূর্ব থেকেই। শহরের তালাইমারী, রামচন্দ্রপুর, রাণীনগর, কাজলা, দরগাহপাড়া, হোসেনীগঞ্জ, হাতেম খাঁন ও তাঁতীপাড়া মহল্লায় বহুকাল পূর্ব থেকেই ঘোড়াগাড়ি চালকদের বসবাস ছিল। স্বাভাবিক কারণে এখানে ঘোড়দৌড়ের আয়োজন হতো ঘটা করে। শহরের কাজলা থেকে আলুপট্টি পর্যন্ত ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতা হতো মূলত ঘোড়াগাড়ি চালকদের মধ্যে। ঈদুল আযহার পরের দিন এই উৎসব বসতো স্থানীয় ইয়াং মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের উদ্যোগে। ১৯২১ সাল থেকে নিয়মিতভাবে উল্লিখিত ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতা হয়ে এসেছে। এর পূর্বেও হয়তো এরূপ কোন প্রতিযোগিতা এই শহরে হতো যার তথ্য ইতিহাসে পাওযা যায়নি। ইংরেজ সাহেবদের দ্বারা প্রবর্তিত ঘোড়দৌড় নিয়মিতভাবে হয়ে এসেছে বর্তমান শহীদ কামারুজ্জামান পার্কের স্থানটিতে। আঠারো-উনিশ এবং বিশ শতকের প্রারম্ভকাল পর্যন্ত বৃটিশ সাহেবরা নিজেরাই এবং মাঝে মধ্যে স্থানীয় জমিদারদের নিয়ে বুনো মহিষ, হরিণ এবং চিতাবাঘ শিকার করতেন।  
১৮২৫ সালের পূর্বে রাজশাহীর সদর দপ্তর ছিল নাটোরে। সে আমলে উত্তর জনপদের মধ্যে নাটোর ছিল অন্যতম বৃহৎ একটি শহর। এই শহরের কানাইখালী নামক মৌজায় নারোদ নদের তীরে রাজশাহীর প্রথম আদালত স্থাপিত হয়েছিল। ধীরে ধীরে কানাইখালী হয়ে উঠলো ইউরোপীয় অধ্যুসিত এলাকা।
কোম্পানি শাসনামলের প্রথম যুগে (১৭৬৫ সালে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লীর সম্রাটের নিকট থেকে দিওয়ানী লাভের পর) প্রশাসনিক ভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট কাজে যে সকল শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী ইউরোপ থেকে বিশেষ করে বৃটেন থেকে ভারতবর্ষে এসে বাংলায় পদার্পণ করেছিলেন তাদের বেশির ভাগ নিজেদের পরিবার পরিজন (স্ত্রী, পুত্র, কন্যা) কলকাতায় রেখে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে চলে আসতেন। অনেকের পরিবার পরিজন কলকাতার পার্শ্ববর্তী হুগলী, চুঁচুড়া, চন্দননগর, ব্যান্ডেল, কাশিমবাজার প্রভৃতি ইউরোপীয় অধ্যুষিত শহরগুলোতেও অবস্থান করতো। জেসুইট এবং অগাষ্টিন ধর্মযাজকদের হিসেব মতে সতের শতকের শেষ ও আঠারো শতকে কেবল হুগলীতেই আট থেকে নয় হাজার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ইউরোপীয়দের বসবাস ছিল। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে মোট খ্রিস্টানের সংখ্যা ছিল পঁচিশ হাজার (বাদশাহী আমলÑফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের পৃ. ২৪১)। প্রাথমিক অবস্থায় কোম্পানি অধিকৃত বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল সমূহে বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থানে শ্বেতাঙ্গরা প্রশাসন ও ব্যবসা বাণিজ্যের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এরা যেসব স্থানে সেই আমলে (আঠারো শতকের শেষ দিকে) অবস্থান করে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করতেনÑ সেই স্থানগুলোকে এক কথায় বলতেন স্টেশন। সেকালে এজাতীয় প্রথম স্টেশনগুলোর মধ্যে প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো ছিল মুড়লী কসবা (যশোর), নাটোর এবং দিনাজপুর। এগুলোকে ফিরিঙ্গী সমাজ স্টেশন নামেই অভিহিত করতেন। ইউরোপ থেকে আগত বিশেষ করে বৃটেনের মানুষেরা কর্ম উপলক্ষে কলকাতা এবং হুগলীর ফিরিঙ্গী সমাজ থেকে বহু দূরে বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সে আমলে যোগাযোগ বলতে ছিল শুধুমাত্র নৌপথ। রেলগাড়ি আবিস্কার হয়নি তখনও। স্থলপথ ছিল যারপর নাই অনুন্নত। কলকাতা কিংবা হুগলী-চুঁচুড়া থেকে নদীপথে যশোর, রাজশাহী, নাটোর, দিনাজপুর, মালদহ (ইংলিশ বাজার) অথবা পূর্ববঙ্গের কোন শহরে ইচ্ছে করলেই চটজলদি যাতায়াত সম্ভব ছিল না। অথচ এসকল ফিরিঙ্গী মানুষদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে অবস্থান করতে হতো মাসের পর মাস কিংবা বছরের পর বছর। শ্বেতাঙ্গ মানুষদের জন্য এটি ছিল দুর্বিসহ এবং অবর্ণনীয় যন্ত্রণার সামিল। কলকাতায় স্ত্রী পরিজন রেখে অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গরা সেকালে এভাবেই নিজ নিজ কর্মস্থলে একাকী দিন অতিবাহিত করতেন।
শ্বেতাঙ্গরা তাদের জীবনের একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা এবং সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্নতাজনিত দুঃখ বেদনা দূর করার উদ্দেশ্যে স্ব স্ব কর্মস্থল বা স্টেশনে হোমলি পরিবেশে নিজেদের দেশের খেলাধুলা(বিলিয়ার্ড, তাস ইত্যাদি), নাচগান, পান- ভোজন এমনকি অশালীন তথা অশ্লীল চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা রেখে গড়ে তুলেছিলেন ক্রীড়া সংগঠনÑ যার নাম স্টেশন ক্লাব। কোন কোন শহরে এর নাম রিক্রিয়েশন ক্লাব (এগুলো পরবর্তী জামানায় অফিসার্স ক্লাব নামে পরিচিতি পেয়েছে)। উত্তর জনপদের প্রথম এবং প্রধান দুটি স্টেশন ক্লাবের মধ্যে একটি নাটোরে এবং অপরটি দিনাজপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দিনাজপুর শহরের বড় ময়দানের মাঝ বরাবর রয়েছে স্টেশন ক্লাবটি। নাটোরে প্রতিষ্ঠিত স্টেশন ক্লাবটি কান্দিভেটুয়া মহল্লায় নারোদ নদের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। দিনাজপুরের স্টেশন ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭৮৫ সালে। যেহেতু নাটোরে কোম্পানি আমলের প্রশাসনিক কাঠামোর প্রথম নিদর্শন আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭৬৯ সালে (১৯ ডিসেম্বর ১৭৬৯ সালে বাউটন রাউজ ইড়ঁমযঃড়হ জড়ঁংব নামক একজন ইংরেজ সুপারভাইজারের নেতৃত্বে কানাইখালী মহল্লায় নারোদের তীরে একটি চালাঘরে প্রথম আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়)। ২/৩ বছরের মধ্যেই ওয়ারেন হেস্টিংস সুপারভাইজারের পদ বিলোপ করে কালেক্টর নামক পদের সৃষ্টি করেন। ১৭৯৭ এবং ১৮০৬ সালের পর পরই কানাইখালীর অপর পাড়ে (নারোদের) দক্ষিণ দিকে কান্দিভেটুয়া মহল্লায় কালেক্টরেট, দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালত নির্মিত হয়। সেই হিসেবে বলা যেতে পারে নারোদের দক্ষিণকূলে কান্দিভেটুয়া মহল্লার স্টেশন ক্লাব ঘরটির জন্ম আঠারো শতকের শেষার্ধে অর্থাৎ ১৭৭০ পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই। বৃটিশ শাসনামলে (উনিশ শতকের শেষ দিকে) নাটোরের মহকুমা প্রশাসক হিসেবে কাজ করে গেছেন সৈয়দ ফাররুখ মির্জা। তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদ নবাব পরিবারের সদস্য। নাটোরের রিক্রিয়েশন ক্লাবটি তাঁর আমলে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি এখানে খেলাধুলাসহ নির্দোষ আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা করে গেছেন।
নাটোর, মুড়লী কসবা (যশোর) কিংবা দিনাজপুর- এই শহরগুলোর মতো পুরাতন শহর রাজশাহী বা রামপুর বোয়ালিয়া নয়। ১৮২৫ সালে নাটোর থেকে প্রশাসনিক দপ্তর রামপুর বোয়ালিয়াতে স্থানান্তরিত হবার পর শ্বেতাঙ্গ সাহেবরা সাহেবগঞ্জ নামক একটি মৌজায় (১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে) বসবাস করতেন। উনিশ শতকের ষাট/সত্তর দশকের দিকে বৃটিশ, ডাচ, ফ্রান্স মিলিয়ে অনূন্য ৫০০ ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গের বসবাস ছিল সাহেবগঞ্জে। এদের মধ্যে কতভাগ সেখানে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন সেটি জানা যায়নি। তবে এরা রাজশাহীতে হুবহু স্টেশন ক্লাবের আদলে কোন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেননি। সাহেবগঞ্জে তাদের নাইটক্লাবের যে আড্ডাখানাটি ছিল সেখানে নির্দোষ কোন আমোদ প্রমোদ হতো তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। ঊনিশ শতকের আশির দশক থেকে তারা ইনডোর গেমস এর পাশাপাশি ফুটবল, হকি, ক্রিকেট এসব আউটডোর গেম খেলতে শুরু করে। এর পূর্বে উল্লিখিত খেলাগুলোর সাথে এ দেশের মানুষের কোন পরিচয় ঘটেনি। সাহেবরা স্থানীয় পাঁচআনী মাঠে এ খেলাগুলো খেলতেন। তারাই সর্বপ্র্রথম ক্লাব নামক ক্রীড়া সংগঠন এদেশে গড়ে তুলেছিলেন। নি¤েœ রাজশাহী শহরের আদি ক্রীড়া সংগঠনগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো।
ভিক্টোরিয়া ক্লাব
রামপুর বোয়ালিয়া প্রকৃতপক্ষে শহর হিসেবে গড়ে ওঠার পর বিশেষ করে উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে নানা ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া বিষয়ক সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে। বড়কুঠীর পদ্মার ঘাট থেকে সোজা প্রায় দুই কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি বর্দ্ধিষ্ণু মৌজার নাম ছিল সাহেবগঞ্জ। রামপুর বোয়ালিয়া শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করে ইউরোপীয় এবং মুর্শিদাবাদসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগত বণিকদের আগমনের কারণে। উনিশ শতকের শুরু থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ অবধি শহরের ব্যবসা বাণিজ্যের উৎকর্ষ ঘটেছিল উল্লেখযোগ্য হারে। এ সময়কালে সাহেবগঞ্জে ইংরেজ, ওলন্দাজ ও ফরাসী ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ শতাধিক। এরা নিজেদের বিনোদনের জন্য একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করার তাগিদ অনুভব করেন। স্থানীয় জমিদারদের সহযোগিতায় উল্লিখিত ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠা পায় রাজশাহীর প্রথম ক্রীড়া বিষয়ক সংগঠন “ভিক্টোরিয়া ক্লাব”। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার (১৮১৯-১৯০১) নামে প্রতিষ্ঠিত ভিক্টোরিয়া ক্লাবঘরটি ছিল সাহেবগঞ্জ মৌজায়। সেখানে ইনডোরগেমসহ ইউরোপীয় সমাজের সাংস্কৃতিক-কর্মকান্ড যেমন নাইটক্লাব সংশ্লিষ্ট আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা ছিল। ইউরোপীয় সাহেবরা মূখ্যত এসব খেলাধুলাও আমোদ-প্রমোদে সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন। ভিক্টোরিয়া ক্লাবের আউটডোর গেম অনুষ্ঠিত হতো পাঁচ আনি মাঠে। এই মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল, হকি- এসব ইউরোপীয় খেলাধুলা প্রথম চালু হয়। ১৮৯০ সালে পাঁচ আনি মঠে রাজশাহীবাসী প্রথম প্রত্যক্ষ করে সাহেবদের দ্বারা অনুষ্ঠিত ক্রিকেট প্রদর্শনী খেলা। এখানে নিয়মিত ফুটবল এবং হকি খেলাও অনুষ্ঠিত হতো। তবে স্থানীয় যুবকদের মধ্যে ক্রিকেট এবং হকি জনপ্রিয় হতে  বেশ সময় লেগেছিল। তবে ফুটবল খেলা সহসাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ক্রিকেট খেলা স্থানীয় মানুষকে আকৃষ্ট করতে না পারলেও এটির প্রতি সে সময়ে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল এবং রাজশাহী কলেজে অধ্যয়নরত নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়ের (১৮৬৮-১৯২৬) আকর্ষণ ছিল সমধিক। লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে এক সময় তিনি কলকাতা পাড়ি জমালেন। ক্রিকেট তাঁর অবচেতন মনে ধারণ করা ছিল। কলকাতা গিয়ে সঙ্গ পেলেন কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া নামক প্রাচীন জনপদের কালীনাথ ওরফে শ্যামসুন্দর মুন্শির পুত্র সারদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, কামদারঞ্জন ওরফে উপন্দ্রে কিশোর রায় চৌধুরী (সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ) প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিদের। সারদারঞ্জন ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি বাংলার যুব সমাজের মধ্যে ক্রিকেট খেলার প্রচলন করেন। তিনি পেশাগত জীবনে কলকাতার মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের (বিদ্যাসাগর কলেজ) অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর পরামর্শ এবং সহযোগিতায় মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় ১৮৯৯ সালে কলকাতার বালিগঞ্জের বুন্দেল রোডে ৪৫ বিঘা বাগান কিনে বাড়ী ও ক্রিকেট মাঠ তৈরি করেন। এটি নাটোর পার্ক নামে পরিচিতি লাভ করে। নাটোর পার্কে ১৯০১ সালে গঠিত হয় নাটোর ইলেভেন নামের একটি ক্রিকেট দল। ১৯০১ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিকেট দলটি সে আমলে ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর অনেক সেরা দলকে হারিয়ে সুনাম অর্জন করেছিল (সূত্র : স্মৃতি পূজা সংখ্যা মানসী ও মর্মবাণী-মাঘ ১৩৩২ বঙ্গাব্দ)।
সাহেবগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত প্রথম ক্লাবঘর “ভিক্টোরিয়া ক্লাব” ১৮৯৭ সালের প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পে পদ্মা গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়ের ফলে সাহেবগঞ্জ মৌজাটি সাহেবগঞ্জ বাজারসহ পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটি জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বর্তমানে কুমারপাড়া সন্নিহিত বারাহী নদীর উৎসমুখের পশ্চিম পার্শ্বে কয়েকটি বাড়ি সাহেবগঞ্জ মৌজাধীন। সেকালের স্থানীয় মানুষেরা সাহেবদের নাইটক্লাবসহ তাদের কর্মকান্ড স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করেনি। যে কারণে সাহেবগঞ্জের বুয়ালিয়া/বোয়ালিয়া ক্লাব ঘরটি ধ্বংসের পর বহুকাল মানুষের মধ্যে একটি প্রবাদ চালু ছিল “পাপ ডুবেছে পদ্মায়, বৃটিশ বলে হায় হায়।”
বুয়ালিয়া/বোয়ালিয়া ক্লাব
বর্তমান বোয়ালিয়া ক্লাবটি আসলে সাহেবগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত ভিক্টোরিয়া ক্লাবের ইনডোর অংশের পরবর্তী রূপ। কুঠিয়াল সাহেবগণসহ স্থানীয় উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের চিত্তবিনোদনের জন্য আশু প্রয়োজন হয়ে পড়ে একটি ক্লাব ঘরের। বর্তমান বোয়ালিয়া ক্লাবের ভবনটি ছিল লালপুর থানাধীন পানসিপাড়া নামক এলাকার জমিদার মোহিনী মোহন রায়ের স্বাস্থ্য নিবাস। পূর্বে রামপুর বোয়ালিয়া পদ্মাতীরের একটি মনোরম স্বাস্থ্যকর স্থান বলে পরিচিত ছিল। এই স্বাস্থ্য নিবাসটি সাহেবরা নিজেদের ক্লাব হিসেবে দখলে নেন। বিশিষ্ট লেখক এবং গবেষক ড. তসিকুল ইসলাম “রাজশাহী বোয়ালিয়া ক্লাবের ইতিবৃত্ত” নামক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, বোয়ালিয়া ক্লাবটির জন্ম হয় ১৮৮৪ সালে । প্রথমাবস্থায় ক্লাবটির সদস্য ছিলেন শুধু বৃটিশ শাসক শ্রেণীর ইংরেজ অফিসার এবং ইউরোপীয় বেনিয়া ব্যবসায়ীগণ। এদেশীয় কোন নাগরিক এমনকি রাজা বা জমিদার শ্রেণীর ব্যক্তিরাও ক্লাবের সদস্যপদ লাভের যোগ্য বলে বিবেচিত ছিলেন না। এমনকি এই ক্লাব অভিমুখে যাবার রাস্তাটিও ছিল সংরক্ষিত। তবে বৃটিশ শাসনের শেষ পর্যায়ে এ অঞ্চলের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ক্লাবে যাতায়াতের সুযোগ পান। ক্লাব সংলগ্ন পশ্চিম দিকের বিশাল মাঠটিতে মাঝে মধ্যে ঘোড়দৌড়ের আয়োজন করা হতো। ঘোড়দৌড় শুরু হতো বর্তমান ডি.আই.জি অফিসের স্থানটি থেকে। সে আমলে রাজশাহীর অনেক রাজা, জমিদার এবং অভিজাত শ্রেণীর মানুষ প্রতিযোগিতামূলক এই ঘোড়াদৌড়ে অংশগ্রহণ করতেন। আর সাধারণ মানুষ তা উপভোগ করতেন। ক্লাব সংলগ্ন ঘোড়দৌড়ের মাঠের পার্শ্বে মোট তিনটি টেনিস লন ছিল। এর মধ্যে দুটি ছিল গ্রাস কোর্ট (ঘাসের) এবং একটি হার্ড কোর্ট (পাকা)। ঘোড়দৌড়ের মাঠের একাংশ গলফ কোর্স (গলফ খেলার মাঠ) হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। বোয়ালিয়া ক্লাবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং ঐতিহ্যবাহী খেলাটি ছিল বিলিয়ার্ড। ক্লাবের বিলিয়ার্ড টেবিলটি ১৮২০ সালে কলকাতার সি ল্যাজারাস এন্ড কোং লিমিটেড কর্তৃক প্রস্তুতকৃত। নাটোর রাজবাড়ি থেকে পরবর্তীকালে এটি বোয়ালিয়া ক্লাবে আনা হয়। বিলিয়ার্ড খেলাকে ঘিরে সে সময় ভারতের বিভিন্ন বড় বড় শহর থেকে নামীদামী খেলোয়াড় এবং অভিজাত ব্যক্তিদের রাজশাহীতে আগমন ঘটতো।
বৃটিশ শাসনামল শেষ হলে এদেশীয় অফিসার এবং শহরের বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রচেষ্টায় বোয়ালিয়া ক্লাবের কর্মকান্ড শ্লথ গতিতে চলতে থাকে। পাকিস্তান আমল পর্যন্ত বিলিয়ার্ড টেবিলকে ঘিরে প্রাণচাঞ্চল্য ও জৌলুস ছিল। বর্তমানে ক্লাবটি তাস খেলা নির্ভর হয়ে গেছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
বোয়ালিয়া ক্লাব ঘরসহ ক্লাবের সর্বমোট জমির পরিমাণ ছিল ৬.৬১ একর। বিভিন্ন সময়ে এই ক্লাবের জমি কেন্দ্রীয় উদ্যান, পুলিশ কমিশনারের বাসভবন, টেনিস কমপ্লেক্স, রাইফেল ক্লাব, স্কোয়াশ ক্লাব ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের জন্য হস্তান্তর হয়ে বর্তমানে ০.৩৮ শতাংশ স্থান নিয়ে বোয়ালিয়া ক্লাবটি টিকে রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এই বোয়ালিয়া ক্লাব। এদেশে বোয়ালিয়া ক্লাবের মতো প্রাচীন ক্লাবের অস্তিত্ত্ব নেই বললেই চলে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বর্তমানে ক্লাবের সভাপতি ও কার্যকরী সহ-সভাপতি পদাধিকার বলে যথাক্রমে রাজশাহী বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার এবং রাজশাহী জেলা প্রশাসক। অন্যান্য সহ-সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক সাধারণ সদস্যবৃন্দের ভোটে নির্বাচিত। ক্লাবটির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছেÑ সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে আগত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের সেতুবন্ধন সৃষ্টির মাধ্যমে ভাব বিনিময় এবং বিবিধ সামাজিক দায়িত্ব পালনে ব্রতী হওয়া। বিভিন্ন ধরনের কর্মকান্ডসহ নির্মল আনন্দের ব্যবস্থা করা। ক্লাবের সকল সদস্যবৃন্দকে শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি উৎসাহিত করা এবং বিভিন্ন সময়ে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। প্রথমাবস্থায় এর নাম ছিল ‘বুয়ালিয়া ক্লাব’। বর্তমানে এর নামকরণ হয়েছে “রাজশাহী বোয়ালিয়া ক্লাব”।