Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার তালিকা

 

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে রাজশাহী তথা সারা বাংলাদেশের সবচেয়ে স্মরণীয় এবং গৌরবময় অধ্যায় হচ্ছে রাজশাহী পুলিশ লাইনের রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ যুদ্ধ। ১৯৭১ এর অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকেই তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি জনপদে আন্দোলনরত ছাত্র জনতার সাথে সকল স্তরের পুলিশ সদস্যগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। এ সকল ঘটনা সমূহ জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ের সংগ্রামী জনগণকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করে তোলে। ২৫শে মার্চের কালো রাত্রে রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণের সংবাদ সারাদেশে ছড়িয়ে পরে। রাজশাহী পুলিশ লাইন সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হতে পারে এমন আশঙ্কা বাঙালী পুলিশ সদস্যদের মনের মধ্যে কাজ করেছিল। এ সকল কারণে আগে থেকেই রাজশাহী পুলিশ লাইনের পুলিশ সদস্যগণ মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে রাজশাহী পুলিশ লাইনের বাঙালী পুলিশ সদস্যগণ নিরাপত্তার জন্য পুলিশ লাইনের চতুর্দিকে পরিখা খনন করেন। কয়েকটি বাংকারও তৈরি করা হয়।
এই ঘটনার ২ দিন পূর্বে অর্থাৎ ২৩ মার্চ রোহনপুরে একটি ঘটনা ঘটেছিল যার প্রতিক্রিয়া রাজশাহীতেও লক্ষ্য করা গেছে। রোহনপুর সীমান্ত ফাঁড়িতে কর্তব্যরত বাঙালী ও অবাঙালী ই.পি.আর-দের মধ্যে ঐ দিন গুলি বিনিময় হয়। সে দিন রাতে একজন অবাঙালী ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে কিছু সৈন্য রোহনপুর ই.পি.আর ক্যাম্পের দিকে আসার চেষ্টা করলে বাঙালী হাবিলদার মোঃ আক্কাসের নেতৃত্বে বাঙালী ই.পি.আর সদস্যরা গুলি ছুঁড়তে থাকেন। এতে ক্যাপ্টেন তার বাহিনী নিয়ে পশ্চাদপসারণ করে। ২৪ মার্চ এই ঘটনাটি তদন্ত করার জন্য মোঃ ইউসুফ নামে একজন অবাঙালী সুবেদার রোহনপুরে আসলে তিনি বাঙালীদের হাতে বন্দী হয়ে নিহত হন। এই ঘটনার প্রভাব রাজশাহীর ই.পি.আর সেক্টর হেড কোয়ার্টার ও উপশহরে অবস্থানরত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মধ্যেও ব্যাপক ভাবে লক্ষ্য করা গেছে।
২৫ মার্চ রাজশাহী শহরে সেনাবাহিনীর সাথে পুলিশের বাঙালী হাবিলদার আবুল কাশেম সহ কয়েকজন পুলিশ কনষ্টবল টহল ডিউটী করছিলেন। এক পর্যায়ে টহলরত সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যের সাথে হাবিলদার আবুল কাশেমের বাক-বিতন্ডা হলে সেনাবাহিনীর অবাঙালী হাবিলদার তাকে বেত্রাঘাত করে। হাবিলদার আবুল কাশেম পুলিশ লাইনে ফিরে এসে এই ঘটনা জানালে পুরা পুলিশ লাইন উত্তেজনায় ফেটে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ঘটনাটি রোহনপুরের পর্যায়ে যাতে না গড়ায় সেজন্য উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ রাজশাহী পুলিশ লাইনের তৎকালীন অবাঙালী আর.আই (রিজার্ভ ইন্সপেক্টর) মাজহার খানকে তাৎক্ষণিকভাবে সারদা পুলিশ একাডেমীতে পাঠিয়ে দেন। সেই রাত্রে রাজশাহী পুলিশ লাইনের চারপাশে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে সারারাত পালাক্রমে সকলেই ডিউটি করেন। সেনাবাহিনী কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ২৫ মার্চ রাত্রে রাজশাহী শহরে টহল দিয়েছিল। পাক বাহিনী সে রাত্রে ই.পি.আর সেক্টর হেড কোয়ার্টার কিম্বা পুলিশ লাইনে আক্রমণ করেনি। পাক বাহিনীর এই টহলকারী দলগুলো সে রাত্রে শহরের নিরাপরাধ কয়েকজন নাগরিককে নির্দয় ভাবে হত্যা করে। এদের মধ্যে এ্যাডভোকেট নাজমুল হক সরকার এম.এন.এ, হাসানুজ্জামান খোকা, সাইদুজ্জামান মিনা, শহীদুজ্জামান বাবু, ওয়াসিমুজ্জামান, আব্দুল হক, আব্দুর রাজ্জাক ও আফজাল মৃধা উল্লেখযোগ্য। এই হত্যাকা-ের ঘটনাগুলো ২৬ মার্চ সকাল বেলাতেই শহরময় ছড়িয়ে পরে। শহরের নিরীহ নাগরিকগণের মধ্যে ব্যাপক ভীতির সঞ্চার হলেও অনেক পাড়া মহল্লায় সকাল থেকেই সাহসী ছাত্র, জনতা বিভিন্ন রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে শুরু করেন। এ কাজে সাদা পোশাকের অনেক পুলিশ ও ই.পি.আর সদস্যগণও ছিলেন।
২৩ মার্চের পর থেকে রাজশাহীর ই.পি.আর সেক্টর হেড কোয়ার্টার পাঞ্জাবী এবং অবাঙালী অফিসার ও জোয়ানদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সেখানে বাঙালী অফিসার বা জোয়ানদের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কিন্তু পুলিশ লাইনের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২৩ মার্চ থেকেই পুলিশ লাইন অস্ত্রাগার ছিল বাঙালী এন.সি.ও এবং সিপাহীদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। সে সময় অস্ত্রাগারের দায়িত্বে ছিলেন হাবিলদার রমজান আলী। সে সময় পুলিশ লাইনের মূল নেতৃত্বে চলে আসেন হাবিলদার আতিয়ার রহমান। তিনি অস্ত্রাগারের চাবি হস্তগত করেন এবং পুরা পুলিশ লাইন তাঁর নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তিনি অস্ত্রাগারের অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সমমনা সকল সিপাহীদের হাতে তুলে দেন। যদিও সে সময় পুলিশ লাইনে বেশ কয়েকজন অবাঙালী সুবেদার, হাবিলদার ও সিপাহী ছিলেন, কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই মনস্তাত্ত্বিক ভাবে ছিলেন দুর্বল। তদুপরি, পাঞ্জাবী সুবেদার এনায়েত খান ছিলেন ষোল আনা বাঙালীদের পক্ষে। এসব কারণে হাবিলদার আতিয়ার রহমানের নেতৃত্বে অস্ত্রগুলি বণ্টন এবং পুলিশ লাইনে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন সহ আসন্ন প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রত্যয় ও প্রস্তুতিতে কোন বাঁধার সৃষ্টি হয়নি।
এ সকল ঘটনা সমূহ পাক সেনাবাহিনীর কাছে অজানা ছিল না।
২৬ মার্চ রাজশাহী সেনানিবাসে পাক বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন মেজর রাজশাহী রেঞ্জের ডি.আই.জি মামুন মাহমুদকে তাঁর অধীনস্থ পুলিশ সদস্যদের আত্মসমর্পন এবং অস্ত্রাগারের চাবি সেনাবাহিনীর কাছে (২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট) হস্তান্তর করার জন্যÑবলেন। ডি.আই.জি মামুন মাহমুদ এতে রাজি হননি। ২৬ মার্চ পাক সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহ, রংপুরে পুলিশের বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে ডি.আই.জি মামুন মাহমুদকে কৌশলে রংপুর ব্রিগেড সদর দপ্তরে ডেকে নিয়ে তাঁর ড্রাইভার সহ তাঁকে হত্যা করে। ডি.আই.জি মামুন মাহমুদের ব্যবহৃত কলম ও চশমা রাজশাহীতে পাঠানো হয়েছিল। (তৎকালীন রংপুরের জেলা প্রশাসক জনাব শামীম আহসান এবং সে সময়ে রাজশাহীর জেলা বিশেষ শাখার গোয়েন্দা কর্মকর্তা জনাব লুৎফর রহমান তালুকদারের দেয়া তথ্য মতে)।
২৬ মার্চ সন্ধ্যার সময় পাক সেনারা কয়েকটি ট্রাক ও পিক আপ ভ্যানে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুলিশ লাইনের কাছাকাছি এসে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়লে এর প্রত্যুত্তরে পুলিশ লাইন থেকে মূহুর্মূহু শত্রুকে উদ্দেশ্য করে গুলি বর্ষন হতে থাকে। উভয় পক্ষের গোলাগুলিতে বেশ কয়েকজন নিরীহ ব্যক্তি প্রাণ হারায়।
২৬ মার্চ রাত্রি ১২.০৫ (২৭/০৩/১৯৭১) মিনিটের সময় পাক বাহিনী পূর্ণ যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হয়ে কয়েকটি সামরিক গাড়ী নিয়ে গীর্জার কাছে এসে পুলিশ লাইনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। (সে সময় পার্ক ছিল না। ফসলের মাঠ ছিল) পুলিশ লাইন থেকে তাৎক্ষণিক ভাবে প্রচ- প্রতিরোধ শুরু হয়। পাক সেনারা এই প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে সরে আসে। তারা পদ্মার পাড়ে, লক্ষ্মীপুর মোড়, ই.পি.আর লাইনের পাশে (বর্তমান টিভি সেন্টার) এবং রেডিও সেন্টারে অবস্থান গ্রহণ করে। পুলিশ লাইন থেকে সারারাত বিক্ষিপ্ত ভাবে গুলিবর্ষণ হতে থাকে।
২৭ মার্চ সকাল থেকেই পাক বাহিনীর বিশেষ তৎপরতা লক্ষ্য করা গেল। পুলিশ লাইনকে লক্ষ্যস্থল করে পাক সামরিক বাহিনী আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গীর্জা, বাঁধের ধার সহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ডিফেন্স গ্রহণ করে।
তারা এভাবেই পুরাদস্তুর যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল। এর পাশাপাশি তারা কিন্তু কূট-কৌশলও গ্রহণ করে। ২৭ মার্চ সকাল অনুমান ১০ টায় পাক বাহিনীর একজন অফিসার মাইকের মাধ্যমে ভাইয়ে ভাইয়ে আত্মঘাতি যুদ্ধ বন্ধের অনুরোধ জানায়। পাশাপাশি আলোচনার মাধ্যমে শান্তি স্থাপনেরও আহ্বান জানায়। কিন্তু এ সবকিছুই ছিল পাক বাহিনীর উদ্দেশ্য হাসিলের কূট-কৌশলমাত্র। রাজশাহীর জেলা পুলিশ সুপার আব্দুল মজিদ পাক বাহিনীর অফিসারের দেয়া আলোচনার আহ্বানে সাড়া দেন। এ ব্যাপারে তিনি পুলিশ লাইনে অবস্থানরত সকল পুলিশ সদস্যদের নিকট বিষয়টি জানালে প্রত্যেকেই আলোচনার বিপক্ষে মতামত দেন। তিনি পুলিশ লাইন ত্যাগ করেন, তবে যাবার আগে সবাইকে দেশের জন্য কিছু করার আহবান জানান। পুলিশ সুপার শাহ আব্দুল মজিদ পি.এস.পি ঐদিন সামরিক বাহিনীর উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে একটি আপোষ রফায় এসেছিলেন যে, উভয়পক্ষের কেউ কাউকে আক্রমণ করবে না। কিন্তু পাক বাহিনী তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈনিকরা পূর্ণ যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হয়ে রাজশাহী উপশহর সেনানিবাস থেকে বিকাল অনুমান তিনটার দিকে পুলিশ লাইনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। সংবাদটি জানার সাথে সাথেই পুলিশ লাইনে আন্দোলরত পুলিশের সদস্যগণ আসন্ন আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈনিকরা দুই দিক থেকে পুলিশ লাইনকে টার্গেট করে ডিফেন্স গ্রহণ করে। পাক বাহিনী পুলিশকে আত্মসমর্পনের জন্য চাপ দিতে থাকে। পুলিশ সুপার শাহ আব্দুল মজিদ এই পরিস্থিতিতে অনন্যোপায় হয়ে ই.পি.আর এর ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর সাথে টেলিফোনে কথা বলেন এবং পুলিশকে সাহায্য করার আহ্বান জানান। রাজশাহীর তদানীন্তন জেলা প্রশাসক পুলিশের ওয়ারলেসে একই আহ্বান জানান। নওগাঁ থেকে এতো দূরের কাঁচা রাস্তা ধরে ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী তাঁর কোর্স নিয়ে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথে মুক্তি সংগ্রামীদের সৃষ্ট ব্যারিকেডে বাধাগ্রস্থ হয়ে সময় মতো রাজশাহী পৌঁছুতে তাঁর অনেক বিলম্ব হয়ে যায়। নওগাঁর ৭ উইং এর উইং কমান্ডার মেজর নাজমুল হক। তিনিও রাজশাহীর উদ্দেশ্যে কোর্সসহ আসার সময় পথে একই ভাবে বাধাগ্রস্থ হন।
ইতিমধ্যে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কনভয় গুলো গীর্জার আশেপাশে রাস্তায় অবস্থান নেয়। সেখান থেকে পাক সেনারা পুলিশ লাইন লক্ষ্য করে গোলাবর্ষন শুরু করে। নওগাঁ থেকে উল্লেখিত ই.পি.আর এর বাঙালী অফিসার সহ বাহিনীর সাহায্য চেয়ে সময় মতো তাদের সহযোগিতা না পাওয়ায় পুলিশ লাইনে সংগ্রামরত পুলিশদের মধ্য থেকেই নেতৃত্ব গড়ে উঠে। হাবিলদার মোঃ আতিয়ার রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। পাক বাহিনীর  গোলাবর্ষণের পর পরই পুলিশ লাইন থেকে এক সাথে অনেকগুলো রাইফেল গর্জে উঠে। এক নাগারে ৩ ঘন্টা উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলে। পাক বাহিনীর দুখানা গাড়ী উল্টে যায়। সমস্ত রাত গোলাগুলি বিনিময় হয়। পুলিশ সদস্যরা অত্যন্ত সুরক্ষিত অবস্থানে থাকায় পাক বাহিনী পুলিশ লাইনের দিকে এগুতে পারে না। সে রাতের যুদ্ধে (২৭ মার্চ) বেশ কয়েকজন পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়েছিল।
২৮ মার্চ সকাল অনুমান ১০টার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর রাজশাহী জেলার তদানীন্তন এ.ডি.সি. সহ সাদা পতাকা উড়িয়ে গোলাগুলি বন্ধ করার জন্য মাইকে আহ্বান করতে থাকেন। এর পর পরই উভয় পক্ষ থেকে গুলি বর্ষন বন্ধ থাকে। ২৫ পাঞ্জাবের মেজর তার ৫/৬ জন সঙ্গী সহ নিরস্ত্র অবস্থায় পূর্বদিকে পায়ে চলার পথ দিয়ে পুলিশ লাইনের মধ্যে প্রবেশ করেন (সে সময় পার্ক ছিল না পূর্ব দিক থেকে লাইনে আসার জন্য ছোট পথ ছিল)। তাঁরা ভাইয়ের দোহাই দেন এবং ভবিষ্যতে উভয় পক্ষ শান্তিতে সহ অবস্থান করবে এই আশ্বাস দিয়ে নিজের বাহিনী সহ সেনানিবাসের দিকে চলে যান। পুলিশ লাইনের মধ্যে তখন কোন সিনিয়র অফিসার কিম্বা যুদ্ধের কৌশল জানা লোক ছিলেন না। পুলিশ লাইনে অবস্থানরত পুলিশের সদস্যরা পাক বাহিনীর মেজরের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে ব্যারাকে ফিরে আসেন। সামান্য কিছু সদস্য বাংকারে ডিউটিতে থেকে যান।
২৮ মার্চ দুপুর ১টার সময় পুলিশের সদস্যরা লাইনে দুপুরের আহারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অনেকে আহাররত অবস্থায়। এই সময়ে পাক বাহিনীরা পুলিশের উপর অতর্কিতে হামলা করে। তারা মর্টার শেলিং ও মেশিনগান থেকে অনবরত গুলিবর্ষন করতে থাকে। বোয়ালিয়া ক্লাবের ছাদে অবস্থানরত পাক বাহিনীর মর্টার শেল নিক্ষেপকারীরা প্রথমে যে শেলটি নিক্ষেপ করে সেটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বর্তমান পুলিশ স্কুলের পশ্চিমে অনুমান ১০০/১২৫ গজ দূরে গোলাম মোস্তফা মোক্তার সাহেবের বাড়ীতে এসে আঘাত করলে গোলাম মোস্তফা, তাঁরপুত্র, ভাগ্নে সহ মোট ৫ জন শহীদ হন। একটি গরুও মারা যায়। এরপরের শেলটি ওয়ারলেস টাওয়ারে আঘাত করলে পুলিশ লাইনের ওয়ারলেস টাওয়ার ভেঙ্গে পড়ে। কয়েকটি ব্যারাকে আগুন লেগে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় পুলিশের সদস্যরা প্রাথমিক ভাবে কিছু বুঝে উঠতে পারেন না। অনেকেই এদিকে ওদিক দৌড়া দৌড়ি করতে থাকেন। যারা বাংকারে ডিউটিরত ছিলেন তাঁরা কিন্তু সাহসের সাথে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। অনেকে অস্ত্র গুলি নিয়ে বাংকারে আসেন কিন্তু আগের তিন দিন তারা যেভাবে প্রতি আক্রমণ করেছিলেন এদিন সেটি করতে ব্যর্থ হলেন। এক পর্যায়ে প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। অনেকে লাইনের পশ্চিমে ভেড়ীপাড়ার মধ্য দিয়ে অস্ত্র গুলিসহ বলুনপুর, কোর্ট ও রায়পাড়ার দিকে চলে যেতে বাধ্য হন। ২৮ মার্চ তারিখের ভয়াবহ যুদ্ধে ১৮ জন পুলিশের সদস্য শাহাদত বরণ করেন। সেই যুদ্ধের একজন প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে কৌশলগত ত্রুটিপূর্ণ অবস্থানের কারণেই সেদিন যুদ্ধরত পুলিশের সদস্যগণ পাক সেনাদের নির্মমতার শিকার হয়েছিলেন। তাঁরা পুলিশ লাইনের উত্তর পূর্ব দিকেই বেশী গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেদিক দিয়ে পাক বাহিনী অগ্রসর হতে পারেনি। কিন্তু দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ বাঁধের দিকটা প্রায় অরক্ষিতই রেখেছিলেন। যেটি ছিল মারাত্মক ভুল। এদিক দিয়েই একদল পাকিস্তানী সৈন্য সুযোগ বুঝে পুলিশ লাইনে ঢুকে পড়ে এবং অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। তারা বাংকারে প্রতিরোধ গড়ে তোলা পুলিশ সদস্যদের বেওনেটের আঘাতে হত্যা করে।
২৯ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দৌলত খাঁনের নিকট ১৮ জন পুলিশ সদস্যের লাশ হস্তান্তর করে। পুলিশ লাইনের মধ্যে আম ও বাবলা গাছে ঘেরা বাগানের মধ্যে তাদের সমাহিত করা হয়। অনুচ্চ প্রাচীর দিয়ে স্থানটি বর্তমানে ঘেরা রয়েছে।
৩১ মার্চ পাক বাহিনী রাজশাহীর জেলা প্রশাসকের সরকারি বাসভবন থেকে রাজশাহী জেলার পুলিশ সুপার শাহ আব্দুল মজিদ পি.এস.পি.কে ধরে নিয়ে সেদিনই তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।